আষাঢ়, ১৪২১ প্রচ্ছদঃ সৈকত মান্না |
মাঠে নামার আগে ১৯ বছরের তরুন একবার আঙ্গুল ছুঁইয়ে নিল সবুজে,
সামনে ইতিহাস অপেক্ষা করছে ওর জন্য। ওদিকে সুদূর ইতালিতে ভাই বোন জমিয়ে বসেছে টিভির
সামনে, বাবা বলে গেছে প্রথম গোলটা ওদের নামেই আসবে। ৩৫ বছরের ডিফেন্ডারটা
যন্ত্রণায় ছটফট করছে সাইডলাইনে, এ জীবনের মত শেষ হয়ে গেল ওর বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন।
এই শতাব্দীর বিস্ময় বালকরা এবার দৌড়াচ্ছে, কেউ সবুজ, কেউ নীল, কেউ সাদা, কেউ কমলা...
একটা দুটো তিনটে বিপক্ষকে পিছনে ফেলে কি নিখুত দক্ষতায় বাঁ পায়ের ভয়ঙ্কর শট... কয়েকশো ক্যামেরা অপেক্ষা করছে ঝলসে ওঠার জন্য,
সারা বিশ্ব মুঠো পাকিয়ে আছে আকাশে ছোড়ার আগে, সারা স্টেডিয়াম মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে
আছে ফেটে পড়ার প্রস্তুতিতে... হাওয়ায় বাঁক নিচ্ছে বাজুকা... একটা নিশ্চিত লক্ষ্যে...
বিশ্বের প্রতিটা খবরের কাগজ অপেক্ষা করছে কালকের হেডলাইনের...শেষে অবিশ্বাস্য সেভ
করে উঠে দাঁড়ালো মেক্সিকোর গোলকিপার।
কি আশ্চর্যের একটা রূপকথা তাই না? এটা কি গ্রিসের অন্ধকবি হোমারের “ওডিসি” কিংবা
আধুনিক জে কে রাওলিং-এর “হ্যারি পটার” সিরিজের থেকে কোন অংশে কম বিস্ময়কর বা কম রোমাঞ্চকর। নিঃসন্দেহে না।
সেই ১৯৩০-এর উরুগুয়ে থেকে ২০১৪-এর ব্রাজিল, দীর্ঘ ৮৪ বছরের রূপকথা। যার গল্প এখনও
কান পাতলে শোনা যায়। বহু বছর আগে বাবার পাশে শুয়ে ১৯৮৬’র আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ
জেতার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাতে যাওয়া। স্বপ্নের মধ্যে মারাদোনার আর এক স্বপ্নের
দৌড়। সেই গল্পের রেশ মনে রেখে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ দেখতে বসা। ১৯৯৮ । জিদানে
ভুগছেন আপনিও। একটা অনন্ত রূপকথা, প্রতি চার বছর অন্তর বিনামূল্যে মাস খানেকের
জন্য কিনে নেয় সব বিনোদনের স্বতঃ। আমার আপনার মত বই পাগল বাঙ্গালীও পালিয়ে বাঁচতে
পারে না। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কলেজ ক্যান্টিন, খেলার মাঠ থেকে
মহাকরণের অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছে যায় একটা হাওয়ার বেলুনের চর্চা। ভালো, খারাপ সবাই
বাবু হয়ে বসে পড়ি ভেসে যেতে। কোন সুদূর দেশের কালো কুঁচকুঁচে ছেলেটা যখন জালে বল
জড়িয়ে এসে চিৎকার করে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে, আমরা দেখতে পাই ওর দীর্ঘ চার বছরের
তিল তিল করে গড়ে তোলা দুর্গের ইতিহাস চিকচিক করছে চোখের কোণে, তখন ফর্সা অফিসবাবুদের
খুব ইচ্ছে করে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতে।
এই ভাবেই লেখা হয়ে যায় রুপকথার একটার পর একটা অধ্যায়, কোন না কোন খণ্ডে আপনিও হয়ত
একটা জলজ্যান্ত চরিত্র। কিন্তু মনে রাখতে হবে খেলাটা কখনোই কারোর জীবনের বাইরে নয়।
একটা শৃঙ্খলা, একটা সৌন্দর্য, একটা শিল্প জড়িয়ে আছে। দিনের শেষে যা একটা জীবনের
প্রেক্ষাপটকেই ফুটিয়ে তোলে। কেউ হাঁটু মুড়ে ভেঙ্গে পরবে কান্নায় কিংবা গর্বের এক
ফালি কাপড় জড়িয়ে ছুটে বেড়াবে মাঠের সীমান্তে। হার আর জিত যে একটা সহজাত ধর্ম, একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে আঙ্গাঙ্গি ভাবে সৃষ্টির আদিমূল থেকে,এই মুহূর্তে তাকে বিশ্বাস
করতে শিখি। কান ফাটানো চিৎকারে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, বর্ণবিদ্বেষ, অরাজকতা,
সন্ত্রাসবাদ দিশেহারা হয়ে পড়বে কয়েক মুহূর্তের জন্য। ভেবে দেখুন অনেক কটা মানুষ
নতুন উদ্যমে উঠে দাঁড়াবে আগামীর দিনের দিকে তাকিয়ে। আমি আপনি যে যার বাড়ী ফিরে
যাব। হাসি মুখে। একটা যুদ্ধের সমাপ্তি এইভাবেও হতে পারে। বদলাচ্ছে সময়। বদলাচ্ছে
সাহিত্যও। আমরা এখন অনেক খোলা মনের মানুষ, এই হারিয়ে যাওয়ার যুগেও আমরা সুন্দর
দেখতে ভালবাসি। তর্জনী তুলে সুন্দর দেখাতে ভালোবাসি।
হার জিতে মেতে না থেকে আমরা উপভোগ করতে ভালবাসি। তাই সকলের উদ্দেশ্যে, খেলা দেখুন,
মেতে উঠুন কিন্তু ভুলে যাবেন না সাহিত্যকে, জীবনকে। ফাকতালে চোখ রাখুন ‘c/o:সাহিত্যে’র
পাতায়। আষাঢ় সংখ্যায় থাকছে কিছু অভিজ্ঞ কলমের সৃষ্টি আর কিছু তরুণের দৃঢ় পদধ্বনি।
অনুবাদ সাহিত্যের কিছু ভালো কাজও থাকল। আর গল্পে এক আবেগপ্লুত স্বপ্ন তুলে ধরল এক
অচেনা কলম। সাথে নিয়মিত বিভাগ তো থাকছেই। পড়ে দেখুন। আপনাদের মতামত জানান। আমরাও
গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চাই। পরিশেষে বলি, ভালো থাকুক ফুটবল, ভালো থাকুন
আপনিও।
সৈকত মান্না
৩রা আষাঢ়,১৪২১