সৃষ্টির আদি থেকেই জগতের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নানা কাহিনী অগ্রসর হয়েছে। আর সেই অতীত কাহিনীকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে নানা লোকবিশ্বাস – যা লোককথা নামে পরিচিত। বিংশ শতাব্দীর ছোটগল্পকার রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরাম তাঁর অনন্য সৃষ্ট ছোটগল্পে সেই অতীত দিনের সংস্কার, বিশ্বাসকে ‘মিথ’ রূপে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষিতে সেই পুরাণ বা অতিলৌকিক ঘটনাগুলি লোককথার আড়ালে যেন বর্তমানের কথা বলে।
মূলপ্রসঙ্গে যাবার আগে ‘মিথ’ এবং ‘মিথের উৎস’ সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন। ইতিহাসের পাতায় নজর রাখলে আমরা জানতে পারি, ‘Myth’ শব্দটির আগমন প্রাচীন গ্রীক ‘Muthos’ থেকে যার অর্থ ‘Anything uttered by a word of mouth’ অর্থাৎ মুখ থেকে নিঃসারিত শব্দ দ্বারা উচ্চারিত কোনো কিছু। গ্রীক কবি হোমার ‘মিথ’ শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন conversation অর্থে, fiction অর্থাৎ গল্প বা কাহিনী
অর্থে নয়। আবার ওডিসিয়াস একে বানানো গল্প বলছেন এবং এরকম ‘বলা’ কে বা ‘কথন’ কে বলেছেন ‘Muthologenevein’ যার অর্থ ছিল ‘telling a story’ অর্থাৎ গল্প বলা; গল্প নয়। অন্যদিকে প্লেটো ‘Muthous’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, মুখ্যত সত্যবর্জিত কিন্তু পুরোপুরি অসত্যও নয় হিসাবে। ‘মিথ’ ও ‘পুরাণ’ দুটি শব্দকে আমরা অনেক সময় সমার্থবোধক বলে মনে করি। কিন্তু ইউরোপীয় সংজ্ঞায় মিথ আর আমাদের পুরাণের মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্য আছে। আসলে আমরা যাকে পুরাণ বলে মনে করি, তার উপকরণগত ব্যাপ্তি মিথের চেয়ে অনেক বেশি এবং ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে যে বইগুলি পুরাণ বলে গণ্য করা হয় তাদের মধ্যে ধর্মীয় প্রতীতি, ইউরোপীয় অর্থের মিথ, কিংবদন্তী এবং বাস্তব ইতিহাসের ভগ্নাবশেষ একত্রিত হয়ে থাকে। মিথের আদি রূপটির মধ্যে ধর্মাচার, দেবতা কল্পনা এবং বিচিত্র ধরনের সংস্কার পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহাবস্থান করে, আর উত্তরকালের কবি শিল্পীরা সেই উপকরণগুলিকে চয়ন বর্জন করে নিজেদের সমসাময়িক জীবনধারার প্রেক্ষিতে সাহিত্যে সাজিয়ে তোলেন। মিথ তার বাইরের আবরণটা পাল্টাতে পাল্টাতে চলে এলেও পুরাণের বহিরঙ্গটি কিন্তু মোটামুটিভাবে অপরিবর্তিতই থেকে যায়।
রাজশেখর বসু (ছদ্মনামঃ পরশুরাম) ( 16ই মার্চ , 1880 – 27শে এপ্রিল, 1960) |
‘ছোটগল্প’ আধুনিক যুগের ফসল। রবীন্দ্রনাথের হাতে যার সার্থক রূপায়ন। ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যে আমরা পাই অল্প পরিসর ঘটনার বর্ণনা, কোনো তত্ত্ব বা উপদেশ নয়। অন্তরের অতৃপ্তি পাঠকের মনে গল্পের শেষটুকু স্মৃতি বহন করে। আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে রাজশেখর বসু পৌরাণিক ‘পরশুরাম’ নামের আড়ালে ছোটগল্পের আঙ্গিক নিয়ে প্রচলিত লোকপুরাণের মৌখিক গল্পগুলিকে নতুন রূপদানের উদ্দেশ্যে ‘ভাঙা-গড়ার’ খেলায় মেতে ওঠেন। আর এই ‘ভাঙা-গড়ার’ খেলায় পরশুরাম যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে গল্পের বুনন তৈরি করেছেন। তুলে ধরেছেন সমাজের নানা সঙ্গতি-অসঙ্গতিকে। সেখানে মুখ্যত পুরাণ কেন্দ্রিক চরিত্রগুলি সরাসরি নামে উপস্থিত হলেও, তিনি প্রচলিত মিথের কাহিনীকে যৎকিঞ্চিত এদিক-ওদিক করে দিয়েই তার ভেতর থেকে এমন কিছু বক্তব্য প্রকাশ করেছেন যা বস্তুতই হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। কিছু কিছু গল্পে প্রত্যক্ষ মিথের ছায়াপথ ঘটেনি; কিন্তু কাহিনীর মূল প্রবণতার মধ্যে কোনো কোনো চরিত্রেরা ঘটনার সঙ্গে একাকার হয়ে মিথ সুলভ অলৌকিক কাহিনী সৃষ্টি করেছে। তাঁর লেখা ‘জাবালি’, ‘যযাতির জরা’, ‘তিনবিধাতা’, ‘পঞ্চপিয়া পাঞ্চালী’, ‘উলট-পুরাণ’, ‘দশকরণের বাণপ্রস্থ’ প্রভৃতি গল্পের মধ্যে প্রচলিত পুরাণ কেন্দ্রিক ঘটনাকে রাজশেখর বসু অনেকটা ফ্ল্যাশব্যাকের ন্যায় দেখিয়েছেন। এই গল্পগুলি আধুনিক সময়ে ‘De-construction’-এ রূপান্তরিত হয়ে অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছে, যা প্রচলিত মিথকে ভেঙে নতুন মিথ তৈরি করেছে।
‘জাবালি’ গল্পে পরশুরাম পুরাণের জাবালি চরিত্রকে নিয়ে এলেও তার মধ্যে আধুনিক মানব
“আমি নাস্তিকের বাক্য বলছি না, আমি নাস্তিক নই; পরলোকাদি কিছু নেই এমনও নয়। আমি সময় বুঝে আস্তিক বা নাস্তিক হই।”
এখান থেকে স্পষ্টত বোঝা যায়, জাবালি আসলে বোঝে মানুষের ধর্ম। যে ধর্ম মানুষকে ধারণ করে, বাঁচার রাস্তাকে মানসিক ভাবে সুগম করে দেয়। তাই সত্য পথে চলা জাবালিকে কোনো লোভ বা মোহ আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আবার এই গল্পেই লেখক দেবরাজ ইন্দ্রের পৌরাণিক মহিমাকে ক্ষুণ্ণ করেছেন। এখানে ইন্দ্রকে দেখানো হয়েছে নিছক কুচক্রী, ভীরু ও সন্দেহবাতিক দেবতা হিসাবে। লোকসমাজে প্রচলিত আছে দেবতারা অন্তর্যামী – যা মুখ্যত মিথ। এ বিষয়ে রাজশেখর বসুর অভিমত –
“কিন্তু বস্তুতঃ তাহাদিগকেও সাধারণ মানুষের ন্যায় গুজবের ওপর নির্ভর করিয়া কাজ করিতে হয় এবং তাহার ফলে জগতে অনেক অবিচার ঘটিয়া থাকে”।
অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন হয়ে নয়, আধুনিক মন দিয়ে যুক্তির দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন পরশুরাম। পুরানো মিথ কে ভেঙে নতুন ধারণার সৃষ্টি করেছেন। তাইতো জাবালি সত্যের আসনে দাঁড়িয়ে তর্জনী নেড়ে বলতে পারে –
“হে চতুরানন, ঢের হইয়াছে। আর বরে কাজ নাই। আপনি সরিয়া পড়ুন, আর ভেংচাইবেন না।”
‘যযাতির জরা’ গল্পে ব্যঙ্গের বিষয় নারী সৌন্দর্যের প্রতি চিরন্তন মোহ। পঁচিশ বছর যৌবন ভোগের পর যযাতির যৌবনে অরুচির কাহিনী মহাভারতে নেই। কিন্তু পরশুরাম দেখিয়েছেন সুন্দরী যুবতি মনোহরাকে দেখে যৌবনে অরুচিগ্রস্থ বৃদ্ধ যযাতি, তার মহাস্থবির পুত্র পুরু, বৃদ্ধ ঋষি বিভীতক ও হরীতক এবং একপাল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সকলেই লালসার কারণে যৌবন আকাঙ্ক্ষা করেছেন। মহাভারত খ্যাত পুরু স্থবিরত্ব দশা কাটিয়ে যৌবন গ্রহণ করে বিবাহে রাজি হয়েছেন। আসলে পরশুরাম মহাভারতের পৌরাণিক বৃত্তান্তে ভোগ ও ত্যাগের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাকে সুকৌশলে বিদ্রূপ করেছেন। শেষের দিকে দারুণ মজার পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গল্পের কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। পুরু তার যৌবন ফিরিয়ে নিয়ে রাণী মনোহরাকে বিবাহ করেন এবং যযাতি তার জরা ফিরে পান। পুরাণ কথাকে উপলক্ষ করে যে সব আধ্যাত্মিক, তত্ত্বকথা বহুসময়ে প্রচারিত হয়ে থাকে, স্বাভাবিক জৈব প্রবণতার বাস্তব ধাক্কায় সেগুলি এক মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে, সেই একান্ত সত্য কথাই পরশুরাম প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে।
পুরাণ সম্পর্কে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ বলেছেন “পুনঃ পুনর্জায়মানা পুরানী” অর্থাৎ যুগে যুগে নতুন নতুন পুরাণের জন্ম হয়েছে। আর সেই সঙ্গে জন্ম হয়েছে মিথেরও। মিথ বিভিন্নভাবে সমাজে অনুপ্রবেশ করে থাকে। কখনো বা বাস্তব ঘটনা আকারে আবার কখনো বা পুরাণ ও মহাকাব্য জাতীয় গাথা থেকে। এমনকি বর্তমান সময়ের কোনো জীবিত মানুষও মিথে পরিণত হতে পারে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান ও কম্পিউটারের প্রযুক্তি থাকলেও সাহিত্যিকদের মন অতীতের সন্ধানে ব্যাকুল। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে যার রসদ তাঁরা খুঁজে পান একটি জাতির ঐতিহ্যের মধ্যে, যেখানে থাকে দীর্ঘদিনের প্রচলিত মিথ। মনোবিজ্ঞানী ইয়ুং –এর মতে ‘collective unconscious’ মন থেকে সৃষ্টি হয় ‘personal conscious’ –যা নব নব মিথের গল্প তৈরি করে। পরশুরামের লেখাতেও এই একই ব্যাপার ঘটেছে। তিনি নিতান্তই সহজ সরলভাবে প্রাচীনকালে দেবদেবী কিংবা লোকসংস্কার যে কতখানি অস্পষ্ট ও অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল, তা আধুনিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যুক্তি-তর্কের মধ্যে দিয়ে খণ্ড খণ্ড ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন হাস্যরসের আড়ালে এবং একালের দর্শনের সঙ্গে মিশিয়ে নতুন গল্প তৈরি করেছেন যা লেখকের ‘personal conscious’-এর নামান্তর বটে। আর এভাবেই পরশুরাম সামাজিক নানা বিষয়ের প্রতি তীব্র কুঠারাঘাত করেছেন এবং মানুষের সুবুদ্ধি, দুর্বুদ্ধিকেও লেখার মাধ্যমে বিদ্ধ করেছেন। এইজন্যই রাজশেখর বসু পরশুরাম ছদ্মনামের আড়ালে মিথিক্যাল পরশুরামের চরিত্র বৈশিষ্ট্য আধুনিকভাবে ব্যবহার করেছেন।
এই সংখ্যার সেরা লেখাগুলির মধ্যে এই লেখাটা অন্যতম। অনেক কিছু জানতে পারলাম। তথ্যে ভরপুর, লেখনী প্রশংসনীয়।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ বন্ধু... মতামত পেয়ে গর্বিত।
উত্তরমুছুন