আমাদের লেখা পাঠান careofsahitya@gmail.com-এ। ভালো থাকুন সকলে। চলতে থাকুক কলম। বলতে থাকুক শব্দ।

প্রচ্ছদ

A SAHITYA-ADDA Initiative C/O:sahitya A BLOG MAGAZIN STAY WITH US THANK YOU
bloggerblogger

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৪

গল্পঃ আমরা আমাদের মত - অভিজিৎ // গবা



















-         -


-         “ দাদা আপনারও কি 498 ?”

এক সেলে আটক ভদ্রলোকের প্রশ্নটা আমি মৃদু হেসে এড়িয়ে গেলাম । আমি যে কি কারণে রাজারহাটের এই নিউ টাউন পুলিশ থানায় খাঁচা বন্দি হয়ে আছি, তার কারণ জানতে পারলে সাধারণ মানুষ কেন , মহাবিপদে পরা এই ভদ্রলোকটিও চমকে উঠবেন ভদ্রলোক বলাটা ভুল হবে, বেশ কমবয়সী বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে মফস্বল এর ছেলে হয়ত আমার মতো তথ্যপ্রযুক্তিতে কর্মরত খুব ক্লান্ত, উত্কণ্ঠিত, অবিন্যস্ত চোখে চশমা , গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বেশ কিছুদিন ধরে বেশ উদ্বিগ্নতায় দিন কাটাচ্ছে ছেলেটি   বেচারা ছেলেটি হয়ত বউ এর সাথে বনিবনার অভাবে গার্হস্থ্য হিংস্রতার ধারায় এখন আপাত জেলবন্দি   অথচ আমার ছেলেটির সাথে কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে শুধু যেই ঘোরের মধ্যে আছি, সেটা অনুভাব করতে চাই   একটা অদ্ভুত আনন্দে মনটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে এখন আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশ সংযত , সাবধানী যে ছেলেটি যেকোনো নিয়ম ভাঙ্গার আগে হাজার বার ভাবে, সে যে অকপটে এতবার কাজ করে জেলে রাত কাটাবে তা স্বয়ং আমার কাছেও আশ্চর্যের বিষয়   তবে আমার নিজেকে আত্ম বিশ্লেষণ না করে এই শ্রীঘরের অনাস্বাদিত অনুভূতিটা উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা বিরল, হয়তো আর হবেও না তাই মনটা বেশ ফুরফুরে   কিন্তু আমার আনন্দটা কেবল শ্রীঘরের অভিজ্ঞতার জন্য নয়, আজকের অনবদ্য দিনটার জন্যও আজ ছিল আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী এই বিশেষ দিনটি আমার আর আমার স্ত্রী ছন্দার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছন্দা কলকাতা এসেছিল মাত্র দুদিনের জন্য আর দিনটা সত্যি স্মরণীয় হয়ে রইল

-         এই যে মিস্টার , আপনি কি ব্যারিস্টার যুধাজিত দাসগুপ্তর ভাই ?”   মোটা কালো মধ্যবয়সী পান চিবতে চিবতে জিজ্ঞাসা করলেন
-         হ্যাঁ , স্যার
-         সত্যি আপনারা পারেন বটে দেশ টাকে কি মগের মুলুক ভাবেন যে যা ইচ্ছে তাই করে যাবেন ? নাকি নিজেকে দাবাং এর সলমান খান ভাবছেন ?”
 এই কথাগুলো শুনে একটু লজ্জা পেলাম বৈকি সত্যই আমার কাছে কোন উত্তর নেই এই মুহূর্তে কোনরকম কৈফিয়ত দিয়ে অতিরিক্ত জটিলতা বাড়াতে চাইনা , তাই মাথা নিচু করে থাকাটাই শ্রেয় ভেবে কিছুক্ষণ নিরুত্তর রইলাম
-         নিন ফোনটা , কথা বলে নিন J.D.G সাথে দাদাতো ভাইয়ের চিন্তায় ফোনে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছেন ।

এই ছোট্ট অন্ধকার সেলটায় ঢোকার আগে আমার যাবতীয় ব্যক্তিগত জিনিষ জমা রাখতে হয়েছে তার আগে অবশ্য দাদাকে ফোন করতে পেরেছিলাম বলে রক্ষে তবে ফোনটা ফেরত পাওয়াতে বেশ স্বস্তি বোধ করলাম   প্রথমে কল করলাম ছন্দাকে , মোবাইলটা স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধ পেলাম ওর ফ্লাইট এখনো বম্বে পৌঁছায়নি   ততক্ষণে দাদার মেসেজ চলে এসেছে – “ আই অ্যাম অন মাই ওয়ে , ডোন্ট ওরি ”.
                                              
                                                  -        -

আইফোন টা আজকেই উপহার দিয়েছে ছন্দা , তাই ফোনটা আরও বেশি প্রিয় আমার কাছে সকালে ওর গানটা রেকর্ড করেছিলাম সেলের একটা কোনায় দাড়িয়ে সেই ভিডিও টা দেখেতে ইচ্ছে করল ভালোবাসি, ভালোবাসি--  এই সুরে কাছে দূরে  /  জলে স্থলে বাজায়, বাজায় বাঁশি ভালোবাসি   গানটা বহুবার শুনেছি ওর গলাতেই শুনেছি কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আবার নতুন ভাবে শুনছি , আর ছন্দাকে নতুন ভাবে অনুভাব করছি ভিডিওটায় সকালের আলোয় আলুলায়িত কেশরাশিতে শাড়ি পরে কি অপরূপ লাগছিলো ওকে   ছন্দার পুরো নাম মধুছান্দা , মধুছন্দা পাইন বিখ্যাত গায়িকা একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব আর সেই মহীয়সীর অধম স্বামী হলাম আমি, অভিজিৎ দাসগুপ্ত , এক সামান্য তথ্য প্রযুক্তিবিদ   আমাদের দিনের পর দিন একে অপরকে ছাড়া থাকতে হয় কিন্তু সেই দূরত্ব আমাদের অন্তরঙ্গতায় , ভাব ভালোবাসায় কখনো অন্তরায় হয়ে ওঠেনি সময়ের সাথে সাথে টান পড়েনি প্রেমের ভাঁড়ারে বরং বেড়েছে , অনেকটা রূপকথার মতো আমাদের ভালবাসা পরিণতি পেয়েছে বিবাহে কিন্তু মাঝেমধ্যে মনের ভেতর একটা ভীতি কাজ করে বটে সাধারণ তথ্য প্রযুক্তিবিদ হয়ে আমি ওর যোগ্য স্বামী হয়ে উঠতে পেরেছি তো ? নিজেকে প্রশ্ন করি সবসময় ওর স্বপ্নের উড়ানের নাবিক হয়ে থাকতে পারবো তো ? নাকি ওর আকাঙ্ক্ষা বদলাবে, চলার পথে হয়ত নাবিক না সহযাত্রী চেয়েছে সে সেই খামতি পূরণ করি কি করে ? অথচ ছন্দা ছাড়া আমার জীবন ছন্দহীন ওর অনুপস্থিতিতে জীবন অর্থহীন এই দুই দ্বন্দ্ব মাঝেমধ্যে আছণ্ণ করে রাখে আমাকে   আজ অবশ্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে, আমাকে নিয়ে নয় , আমার এই ঘটনা মিডিয়া খবরের কাগজ হলে ছন্দার মানহানি না হয়   চার-কান হলে টানাটানি শুরু না হয় খ্যাতির ভাঁড়ারে চিড় না ধরে জানিনা কি হবে কাল সকালে   আমার ভাবনার রেস কাটল পাশের ছেলেটির প্রশ্নে ছেলেটি বেশ সংকোচের সাথে জিজ্ঞাসা করলো
-         দাদা , আপনার দাদা কি উকিল ?

স্বাভাবিক ভাবেই ওর চোখমুখ বেশ অসহায় দেখাচ্ছে এর মতো অজামিনযোগ্য অপরাধ বহু সাধারণ ছেলের সুনাম ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যায় নাড়িয়ে দিয়ে যায় ভেতরের আত্মবিশ্বাস

-         হ্যাঁ , তোমার বাবা মার সাথে যোগাযোগ করেছো ?”
-         না , উনারা বহরমপুরে থাকেন
-         ফোন করবে ?”
-         না দাদা, উনারা অপ্রয়োজনীয় দুশ্চিন্তা করবেন বয়সকালে এই ধাক্কা নাও সামলাতে পারেন কথায় আমার জাঁদরেল শাশুড়ির সাথে পারবেন না শেষ মেশ উনাদের না আবার জেলে পুরে দেন

আমার এবার খারাপ লাগলো হয়ত কতো কষ্ট করে মানুষ করেছে ছেলেটির বাবা-মা কতবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আজ এই উচ্চতায় পৌঁছেছে কিন্তু জীবন বড় নির্মম আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলেছে আবার অবতীর্ণ হতে হয়েছে জীবন পরীক্ষায়

-         দাদার হেল্প চাও তুমি ?”
-         হ্যাঁ, বিশেষ উপকার হয় ।”

আমি ছেলেটিকে আশ্বস্ত করলাম যে কাল সকালের মধ্যে তাকে যথাসম্ভব প্রচেষ্টায় কোর্ট থেকে চালান বার করে এখান থেকে মুক্ত করব সামনে লম্বা রাত , একটু জিরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলাম যদিও জানি এই উদ্বিগ্নতায় কোনরকম ঘুম আসা সম্ভব নয়   অথচ কি অদ্ভুত জীবনের অনুভূতিগুলো এই অন্ধকার অপরিষ্কার খাঁচার মধ্যে দুই সমবয়সী যুবক জীবনের প্রথম শ্রীঘর অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে অনুভব করছে এটাই কি অদৃষ্টের প্রভাব নাকি জীবন সাথী চয়নের ফলাফল নাকি মুহূর্ত সৃষ্টির ক্ষমতাই উপহার দেয় জীবনের অনাবিল মুহূর্ত গুলকে

                                                   -       -

রাজারহাট এই থানাটা অ্যাকশন এরিয়া তিনে উদ্বোধন হয়েছে মাস কয়েক আগে আমাদের সেলটা থানার দোতালায় সেলের ছোট্ট জানালা দিয়ে রাতের আলতে নতুন তৈরি হওয়া টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল আর আলোক উদ্ভাসিত ইউনিটেক আইটি পার্ক সন্নিবিষ্ট এলাকা দারুণ লাগছিল মন যখন ভাল থাকে তখন মনে হয় সাধারণের মধ্যেও আমরা অসাধারণত্ব খুঁজে পাই যদিও আজ নিউটাউন নিরিবিলি রবিবার বলে তাও জানালা থেকে ঝাঁ চকচকে লাগছে আলকজ্জল আইটি পার্ক গুলো রাস্তা গুলো বেশ বড় বড় , সুন্দর করে বাঁধানো গাড়ি চালিয়ে যে কি মজা তা আমার চেয়ে ভাল কে অনুভব করেছে ! ভেবে  একটু হাসিই পাচ্ছে

আজ দিনটি ছিল ঘটনাবহুল সকালে উঠেই উপহার পর্ব ছন্দা একদিন বলেছিল ওর সোনার গয়নাগুলো বেশ বড় বড় সবসময় পরার একটা হালকা মঙ্গলসূত্র কিনলে হয় ওর মনের মতো উপহার দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ আমি অপব্যবহার আমি করি নি আর আমি পেয়েছি সদ্য বাজারে আসা আইফোন ছয় উপহারগুলো একে অপরের বেশ পছন্দ হয়েছে দুপুরের পারিবারিক মধ্যাহ্নভোজনর পালা সেরে বসেছিল গানের আসর ছন্দার গানের যাদু মাতিয়ে তুলেছিল আমাদের প্রাঙ্গণ অদ্ভুত সন্মোহনি শক্তিতে আবেশিত হয়ে পরেছিলাম আমরা সকলে ঠাহর করতে পারছিলাম না কোথা থেকে দিনটা চলে যাচ্ছিলো আর ওকে সন্ধ্যার বিমানে ফিরে যেতে হবে বলে যেন গোটা দিনটা ছোট লাগছিলো কোথাও যেন ছিল আরেটু পাওয়ার ইচ্ছে, আরেকটু উচ্চতার হাতছানি   

সন্ধেবেলা আমরা বেরলাম হাতে সময় রেখে পরিকল্পনা মাফিক নৈশভোজ করতে গিয়েছিলাম বাইপাসের এক রেস্তোরায় ঠিক ডিনার নয়   আর্লি ডিনার বলা যেতে পারে উদ্দেশ্য নিজেদের সাথে একান্তে আরও একটু সময় কাটানো , আর তারপরে ওকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসা আর সেই পথেই হল যত বিপত্তি    ঠিক বিপত্তি নয়, অনেকটাই পাগলামো ছান্দার সাথে সারাদিন কাটানোর পরেও ঠিক মন ভরছিল না মনে হচ্ছিল আরও একটু সঙ্গ পেলে ভাল হত, কোথায় যেন খামতি থেকে গেল দিনটায় অথচ আজ ওকে যেতেই হতো কাল সকালে গানের রেকর্ডিং আছে ছান্দার আমি চাই না কাজের ব্যাপারে ছন্দা আপোষ করুক কাজের উৎসর্জনই ভারসাম্য আনে ব্যক্তিগত জীবনে ওর উন্নতিতে আর খ্যাতিতে আমি বেশ গর্ববোধ করি   

রাত এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা ছন্দার ফ্লাইট বম্বে পৌঁছল বলে হয়তো খুব চিন্তায় গেছে ওর শেষ দুটো ঘণ্টা দক্ষিণ কোলকাতা থেকে দাদার আস্তে আরও কিছুটা সময় লাগবে এসব ভাবতে ভাবতে দুরের নিউ টাউন দেখছি, এমন সময় টনক নড়ল এক রমণীর অসময় আবির্ভাবে চুল উষ্কখুষ্ক, বিচলিত চোখেমুখে উদভ্রান্তির ছাপ আর আশ্চর্যের বিষয় এই যে তাকে দেখে আমার সেলের ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে উঠল রাগে ক্ষোভে শিকগুলো আঁকড়ে ধরেছে সে  

- “ তোমার স্ত্রী নাকি ?”
- “ হ্যাঁ দাদা আরও কতো বিপদ আনতে চলেছে জানি না
আমি একটু অবাক হলাম এতো রাতে একা 498  দেওয়ার পরে কোন স্ত্রী তাঁর স্বামীকে শ্রীঘরে দর্শন করতে আসতে পারে ?
মেয়েটি দৌড়ে এলো আমাদের সেলের দিকে এক অবিন্যস্ত চাঞ্চল্য তার সর্বাঙ্গে
- “ সোনা, আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে আমি আর মায়ের কথা শুনবো না
ছেলেটি মুখ ফিরিয়ে শিকগুলো ধরে মাথা নিচু করে বসে পড়লো ক্ষোভ-লজ্জা-কষ্ট মাখানো চোখদুটি মেঝের দিকে নিবদ্ধ  
-          বাবু আমায় ক্ষমা করে দাও দ্যাখো, আমি তোমায় নিতে এসেছি সেই দুপুর থেকে কিছু খাইনি আমি তোমাকে ছাড়া ঘুম আসেনা আমার , এটা জানোত তুমি প্লিজ বাড়ি চলো
 এই নাটকে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না ভাবছি যে বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের দেশও সব পেয়েছির দেশে পরিণত হয়েছে কিন্তু সামাজিক ভাবে আমাদের মানসিকতা এখনও পরিণত হয়েছে কি ? এই বিশ্বায়নের যুগে এক শ্রেণীর মেয়েদের কাছে পৃথিবীটা মগের মুলুক, আর স্বামীরা সান্তা ক্লোজ হয়তো সমস্যাটা আরও গভীর, অসহিষ্ণু সমাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতার   অলীক প্রত্যাশা কিংবা পারিবারিক হস্তক্ষেপও অনেক খানি দায়ী , কিন্তু এব্যাপারে সন্দেহ নেই যে 498 নামক যন্ত্রটি অসদুদ্দেশ্যে প্রয়োগ হচ্ছে আজকাল   মেয়েটি অঝরে কাঁদছে ওর কান্না দেখে আমার একটু মায়া হল বটে
-           কি হয়েছে গো , কথা বলছেনা কেন ? আমি তোমায় ছেড়ে বাপের বাড়ি যাবো না আর তোমার দিব্যি
আমি ছেলেটার পীঠে হাত রেখে বললাম – “কথা বলো
ততক্ষণে দারোগা সেলের দরজা খুলে দিয়েছে   ছেলেটি বেরিয়েই অপ্রত্যাশিত ভাবে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল আর আমি ভাবলামসত্যি ছন্দা, কি বিচিত্র এই বঙ্গদেশ কি বিচিত্র এখানকার নর নারী সবাই আলাদা, সকলের আলাদা রসায়ন আর রসায়নে কিছু বাহ্যিক উপাদান এসে সমীকরণটা ঘেঁটে দেয় হয়তো এক্ষেত্রে কোন জাঁদরেল শাশুড়ি তার মেয়েকে ইন্ধন যুগিয়েছে সত্যিটা কি তা কেউ বলতে পারবে না, কারণ সকলের আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থাকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য বলে কিছু হয়না হয় কার্যকরী নয় বিচ্ছেদ , কোন যুক্তিবিজ্ঞান দিয়ে বাঁধা যায় না সম্পর্কের সমীকরণ    তবে দিনকাল ক্রমশ বদলাচ্ছে আধুনিক বঙ্গীয় যুবক যুবতীরা যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্য , পরিণত ঠিক দুই দশক আগে সমাজ চলত অন্য ভাবে শোনা যেত বিয়েতে বাড়ির অসন্মতির কথা , কিংবা ত্রিকোণ প্রেম, অথবা জবরদস্তি বিয়ে দেওয়া, বা প্রেম ছিনিয়ে আনা কিন্তু প্রায় সব গল্পই শেষ হত বিয়ের পিঁড়িতে এখন সমাজ একটু বদলেছে বর্তমানের বিবাহিত স্বামী স্ত্রী দের বন্ধুও তারা, শত্রুও তারা সময়ের সাথে বায্যিক সম্পর্কের অবকাশ বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অফিসিয়াল পরিচিতি অবকাশ সর্বত্র কিন্তু নিজেদের বিশ্বাস সমীকরণ রসায়ন ঠিক থাকলে হাজার অবকাশও সেই দুর্ভেদ্য সম্পর্কের প্রাচীর ভেদ করতে পারে না আর যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই সমস্যা থাকে, তখন বিকল্প নানা দিক দিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাই আজকের শিক্ষিত পার্টনারকে পাহারা দিতে হয় না শুধু মন খুলে হৃদয় দিয়ে সম্পর্কটা রাখতে হয়, নিজের মতো করে    ঠিক এই কারণে আমি ছন্দাকে নিয়ে নিরাপত্তা হীনতা অনুভব করি নি   যতই দূরে থাকুক, যত লোকের সাথেই মিশুক, আমার প্রতি ওর ভালোবাসা অটুট থাকবে  

                                                 -      -

আমার কাছে জীবন হল মুহূর্তের সমষ্টি আর প্রতিটি মুহূর্ত আলাদা আলাদা ক্যানভাস তাই প্রতিটি ক্যানভাসকে বর্ণবহুল করার দায়িত্বও আমাদের তাতে রঙের ছটা ফেলে , নিজের মনের মাধুরী ঢেলে আমরাই সাজাতে পারি রঙিন করে তুলতে পারি ক্যানভাসগুলো , যেগুলি রয়ে যাবে স্মৃতির মণিকোঠায় , চিত্ত ভরিয়ে দেবে অনাবিল আনন্দে   আমার বার বার মনে পরছে আজকের কিছু মুহূর্ত লাল ট্র্যাফিক সিগন্যাল ভেঙ্গেছি নিজের খামখেয়ালীতে কিংবা অনেকটা নিজের ইচ্ছেতেই ছন্দাকে খুশি করতে, ফুরিয়ে যাওয়া দিনটিকে চরম উচ্চতা দিতে বা হয়তো আমার বাঁধভাঙ্গা ভালোবাসা উজাড় করে দিতে জানিনা কেন এরকম করেছি, এর পেছনে গুঢ় রহস্য কি, তবে কি সত্যই আমি নিরাপত্তা হীনতায় ভুগি ! নাকি ছন্দার ভালোলাগাগুলো আমার চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে !  না , নিরাপত্তা হীনতা নয় আবার নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়াও নয় কোন সম্পর্ক কেই টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নেওয়া ঠিক নয় ছন্দা আর পাঁচটা মেয়ের মত নয়, যারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা করবে আর নারীবাদী বুলি আওড়াবে বিলেনিয়ার প্রয়োজককে  জীবনসঙ্গী করে, তার থেকে রোমান্স না পেলে উগরে দেবে বিদ্বেষের ফল্গুধারা আজকের মেয়েরা প্রেম করবে সহপাঠীর সাথে, আর বিয়ে করবে এন আর আই কে, নিজেদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উচ্চ প্রতিষ্ঠিত , উচ্চ উপার্জন করা ছেলেকে জীবনসঙ্গী করে সাম্যের গান গাইবে ছন্দা সে পথে হাঁটেনি আমি ওর সহপাঠী প্রেমিক আমাদের পারস্পারিক শ্রদ্ধা আর একে অপরকে খুশি করার অকৃত্রিম ইচ্ছের জন্য, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে ভালোবাসাতে  চিড় ধরেনি    আর এই উপচে যাওয়া ভালোবাসা উপহার দিতে গিয়েই যত বিপত্তি যদিও বিপত্তিটা মটেই খারাপ লাগছে না, বরঞ্চ অনুভব করছি তাড়িয়ে তাড়িয়ে ঠিক যেমন অনুভব করেছিলাম বাইপাসের ওপর লাল ট্র্যাফিক সিগন্যাল ভেঙ্গে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছিল এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে তাই পঞ্চম গিয়ারে গাড়িটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি নি আর সেই নিয়ম ভাঙ্গাটা ছন্দাকে দারুণ উত্তেজিত করে তুলেছিল ট্রাফিক পুলিশের পেছন থেকে দাণ্ডা তুলে চিৎকার আমাদের গাড়ির মধ্যে তুলেছিল আলোড়নের জোয়ার চনমনে হয়ে উঠেছিলো ছন্দা আর সেই ভালোলাগার ছোঁয়া আমাকে করে তুলেছিল আরও বেপরোয়া  
আবার ভাঙ্গলাম সিগন্যাল হ্যাঁ , একবার নয়, বেশ কয়েকবার রবিবার বিকালের অপেক্ষাকৃত শান্ত বাইপাসে একশোর গতিবেগে গাড়িটাকে ছোটালাম সাথে বিট দেওয়া বলিয়ুডী গানগুলো উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের যেন শুটিং করছি জার্মানির অটোবানে যেখানে নেই কোন গতির বিধিনিষেধ সেই গতিবেগের নিষেধ হয়ত ভারতবর্ষেও নেই, কিন্তু লাল সিগন্যাল আছে , ট্র্যাফিক পুলিশের সাথে আছে সার্জেন্টের দল আর ভাগ্যিস আছে, তা না হলে খেলাটাই জমত না   আমাদের স্বপ্নের ড্রাইভটা রাতারাতি হয়ে গেল ভিডিও গেমস এই তাসের দেশে যখন নিয়ম ভাঙ্গার খেলায় মেতেছি তখন প্রাণ খুলে ভাঙ্গি আর সেই অনাস্বাদিত আনন্দ ততক্ষণে প্লাবিত করেছে ছন্দাকে ওর চোখে একদিকে উদ্বিগ্নতা অন্যদিকে উত্তেজনার আনন্দ কিন্তু মুখে সাবধানী বুলি – “কি করছ অভি, থামো” ! আর আমি গতি তুলেছি আরও জোড়ে পেছনে কলকাতা পুলিশের বাইক বাহী সার্জেন্টের দল, আর কিছুক্ষণ পরে একটা ভ্যানও দেখলাম সাইরেন বাজিয়ে ধাওয়া করছে আমাদের    আমার ভীষণ ভাল লাগছিলো নিয়ম ভাঙ্গতে, আর সেই অকল্পনীয় মুহূর্তটাকে ছন্দাকে উপহার দিতে মনে হচ্ছিল এতক্ষণে সার্থক হল দিনটা এরপর যা হওয়ার হবে, দেখা যাবে ছোটাই আরও একটু    আমার মতো ভীতু সাধারণ নিয়ম মানা তথ্য প্রযুক্তির ছেলে যে সামান্য ক্লায়েন্ট এস্কালেসনে আতকে ওঠে , তার মধ্যেও কত ছায়াবৃত আমার মধ্যে থেকে যে এমন একটা চরিত্র বেড়িয়ে আসবে , সেটা ছন্দা কেন আমার নিজের কাছেও চরম অবিশ্বাস্য কিন্তু সাথে সাথে সাবধানী মাথা বারংবার মনকে বোঝাচ্ছিল যে এই দু:সাহসিক বিপজ্জনক কর্মপ্রচেষ্টার চক্করে ছন্দার ফ্লাইট না মিস হয়ে যায়    তাই হঠাৎ বাইপাস থেকে ডানদিক নিয়ে ঢুকে পরলাম সল্টলেকে , কোলকাতা পুলিশের এক্তিয়ার থেকে বেড়িয়ে রাজ্য পুলিশের চত্বরে জানতাম সোজা গেলে, উল্টোডাঙা ফ্লাইওভার অতিক্রম করলেই পড়তাম কোলকাতা পুলিশের বেড়াজালে    সল্টলেক পেরিয়ে রাজারহাট হয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে বেশী সময় লাগলো না সারাক্ষণ বড্ড উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ছন্দাকে এই চলচ্চিত্রিক অভিজ্ঞতার ফলস্বরুপ মাত্রাতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ আমাদের নিয়ে গেয়েছিল এক অন্য জগতে ছন্দা গান ধরেছিল – “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো ...
পথ শেষ হয়েছিল এবং পরবর্তী ব্যাপারটা আপাত সুখকর হয় নি ছন্দা যথাসময়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছেছিলো এয়ারপোর্ট ছেড়ে রাজারহাটের রাস্তা ধরতেই রাজ্য পুলিশের সহায়তায় কোলকাতা পুলিশ আমায় ধরেছিল এয়ারপোর্টের টোল পোস্টে আমার গাড়ির নাম্বার ট্র্যাক করে   আর তার ফলস্বরূপ এই শ্রীঘরের অমোঘ অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি হল আজ
 দাদা এসেছে পেপার ওয়ার্ক সারছে এমন সময় এলো ছন্দার ফোন
-         তুমি ঠিক আছো তো ? ”
-         একদম বিন্দাস
-         আমি তোমায় ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি   আবেগমথিত কম্পমান গলায় বলল ছন্দা
জীবনখাতার এই ড্রাইভের ক্যানভাসটায় আমাদের প্রেমের রামধনুর সবকটা রঙ বর্ণবহুল হয়ে থাকবে চিরকাল  

                                               ---------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

CSS Drop Down Menu
আমাদের লেখা পাঠান careofsahitya@gmail.com- এ মেল করে।