- ১ -
- “ দাদা আপনারও কি
498 ?”
এক সেলে আটক ভদ্রলোকের প্রশ্নটা আমি মৃদু হেসে এড়িয়ে গেলাম । আমি যে
কি কারণে রাজারহাটের এই নিউ টাউন পুলিশ থানায় খাঁচা বন্দি হয়ে আছি, তার কারণ জানতে পারলে সাধারণ মানুষ কেন
, মহাবিপদে পরা এই ভদ্রলোকটিও চমকে উঠবেন । ভদ্রলোক বলাটা ভুল হবে,
বেশ কমবয়সী । বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে মফস্বল এর
ছেলে ।
হয়ত আমার মতো তথ্যপ্রযুক্তিতে কর্মরত । খুব ক্লান্ত, উত্কণ্ঠিত, অবিন্যস্ত
। চোখে চশমা , গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । দেখে বোঝা যাচ্ছে যে
বেশ কিছুদিন ধরে বেশ উদ্বিগ্নতায় দিন কাটাচ্ছে ছেলেটি । বেচারা
ছেলেটি হয়ত বউ এর সাথে বনিবনার অভাবে গার্হস্থ্য হিংস্রতার ধারায় এখন আপাত জেলবন্দি । অথচ আমার ছেলেটির সাথে কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে
। শুধু যেই ঘোরের মধ্যে আছি, সেটা অনুভাব
করতে চাই । একটা অদ্ভুত আনন্দে মনটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে এখন ।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশ সংযত
, সাবধানী ।
যে ছেলেটি যেকোনো নিয়ম ভাঙ্গার আগে হাজার বার ভাবে, সে যে অকপটে এতবার কাজ করে জেলে রাত কাটাবে তা
স্বয়ং আমার কাছেও আশ্চর্যের বিষয় । তবে আমার নিজেকে আত্ম বিশ্লেষণ না করে এই শ্রীঘরের অনাস্বাদিত অনুভূতিটা
উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে ।
জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা বিরল, হয়তো আর হবেও না । তাই মনটা বেশ ফুরফুরে । কিন্তু আমার আনন্দটা কেবল শ্রীঘরের অভিজ্ঞতার জন্য নয়, আজকের অনবদ্য দিনটার জন্যও ।
আজ ছিল আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী । এই বিশেষ দিনটি আমার আর
আমার স্ত্রী ছন্দার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ । ছন্দা কলকাতা এসেছিল মাত্র দুদিনের জন্য ।
আর দিনটা সত্যি স্মরণীয় হয়ে রইল ।
- “ এই যে মিস্টার
, আপনি কি
ব্যারিস্টার যুধাজিত দাসগুপ্তর ভাই ?” মোটা কালো মধ্যবয়সী পান চিবতে চিবতে জিজ্ঞাসা করলেন ।
- “ হ্যাঁ , স্যার ।”
- “সত্যি আপনারা পারেন বটে । দেশ টাকে কি মগের মুলুক ভাবেন যে
যা ইচ্ছে তাই করে যাবেন
? নাকি নিজেকে দাবাং এর সলমান খান ভাবছেন ?”
এই কথাগুলো শুনে একটু লজ্জা পেলাম বৈকি । সত্যই আমার কাছে কোন উত্তর নেই ।
এই মুহূর্তে কোনরকম কৈফিয়ত দিয়ে অতিরিক্ত জটিলতা বাড়াতে চাইনা , তাই মাথা নিচু করে থাকাটাই শ্রেয় ভেবে কিছুক্ষণ নিরুত্তর রইলাম ।
- “নিন ফোনটা , কথা বলে নিন
J.D.G র সাথে । দাদাতো ভাইয়ের
চিন্তায় ফোনে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছেন ।”
এই ছোট্ট অন্ধকার
সেলটায় ঢোকার আগে আমার যাবতীয় ব্যক্তিগত জিনিষ জমা রাখতে হয়েছে ।
তার আগে অবশ্য দাদাকে ফোন করতে পেরেছিলাম বলে রক্ষে । তবে ফোনটা ফেরত পাওয়াতে বেশ স্বস্তি বোধ করলাম । প্রথমে কল
করলাম ছন্দাকে
, মোবাইলটা স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধ পেলাম । ওর ফ্লাইট
এখনো বম্বে পৌঁছায়নি । ততক্ষণে দাদার মেসেজ চলে এসেছে
– “ আই অ্যাম অন মাই ওয়ে , ডোন্ট ওরি
”.
- ২ -
আইফোন টা আজকেই উপহার দিয়েছে ছন্দা
, তাই ফোনটা আরও বেশি প্রিয় আমার কাছে ।
সকালে ওর
গানটা রেকর্ড করেছিলাম । সেলের একটা কোনায় দাড়িয়ে সেই ভিডিও টা
দেখেতে ইচ্ছে করল । “ ভালোবাসি, ভালোবাসি-- এই সুরে কাছে দূরে / জলে স্থলে বাজায়,
বাজায় বাঁশি ॥ ভালোবাসি ॥” গানটা বহুবার শুনেছি । ওর গলাতেই
শুনেছি ।
কিন্তু আজ
মনে হচ্ছে আবার নতুন ভাবে শুনছি , আর ছন্দাকে
নতুন ভাবে অনুভাব করছি ।
ভিডিওটায় সকালের আলোয় আলুলায়িত কেশরাশিতে শাড়ি পরে কি অপরূপ লাগছিলো
ওকে । ছন্দার
পুরো নাম মধুছান্দা , মধুছন্দা পাইন । বিখ্যাত গায়িকা
। একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব ।
আর সেই মহীয়সীর অধম স্বামী হলাম আমি, অভিজিৎ
দাসগুপ্ত , এক সামান্য তথ্য প্রযুক্তিবিদ । আমাদের দিনের পর দিন একে অপরকে ছাড়া থাকতে হয় ।
কিন্তু সেই দূরত্ব আমাদের অন্তরঙ্গতায় , ভাব ভালোবাসায় কখনো অন্তরায় হয়ে ওঠেনি । সময়ের সাথে সাথে টান পড়েনি প্রেমের ভাঁড়ারে । বরং বেড়েছে , অনেকটা রূপকথার মতো আমাদের ভালবাসা পরিণতি পেয়েছে বিবাহে । কিন্তু মাঝেমধ্যে
মনের ভেতর একটা ভীতি কাজ করে বটে ।
সাধারণ তথ্য প্রযুক্তিবিদ হয়ে আমি ওর যোগ্য স্বামী
হয়ে উঠতে পেরেছি তো ? নিজেকে
প্রশ্ন করি সবসময় ওর স্বপ্নের উড়ানের নাবিক হয়ে থাকতে পারবো তো ?
নাকি ওর
আকাঙ্ক্ষা বদলাবে,
চলার পথে হয়ত নাবিক না
সহযাত্রী চেয়েছে সে । সেই খামতি পূরণ করি কি করে
? অথচ ছন্দা ছাড়া আমার জীবন ছন্দহীন । ওর
অনুপস্থিতিতে জীবন অর্থহীন । এই
দুই দ্বন্দ্ব মাঝেমধ্যে আছণ্ণ করে রাখে আমাকে । আজ অবশ্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে, আমাকে নিয়ে নয় , আমার এই ঘটনা মিডিয়া খবরের কাগজ হলে ছন্দার মানহানি না
হয় । চার-কান হলে টানাটানি শুরু না
হয় ।
খ্যাতির ভাঁড়ারে চিড় না ধরে । জানিনা কি হবে কাল সকালে । আমার ভাবনার রেস কাটল পাশের ছেলেটির প্রশ্নে ।
ছেলেটি বেশ সংকোচের সাথে জিজ্ঞাসা করলো –
- “দাদা , আপনার দাদা কি উকিল ?
স্বাভাবিক ভাবেই ওর
চোখমুখ বেশ অসহায় দেখাচ্ছে ।
এর মতো অজামিনযোগ্য অপরাধ বহু সাধারণ ছেলের সুনাম ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যায় ।
নাড়িয়ে দিয়ে যায় ভেতরের আত্মবিশ্বাস ।
- “হ্যাঁ , তোমার বাবা মার সাথে যোগাযোগ করেছো ?”
- “ না , উনারা বহরমপুরে থাকেন ।”
- “ফোন করবে ?”
- “ না দাদা, উনারা অপ্রয়োজনীয় দুশ্চিন্তা করবেন । বয়সকালে এই ধাক্কা নাও সামলাতে পারেন । কথায় আমার জাঁদরেল শাশুড়ির সাথে পারবেন না
। শেষ মেশ উনাদের না
আবার জেলে পুরে দেন ।”
আমার এবার খারাপ লাগলো । হয়ত কতো কষ্ট করে মানুষ করেছে ছেলেটির বাবা-মা । কতবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আজ
এই উচ্চতায় পৌঁছেছে । কিন্তু জীবন বড় নির্মম । আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলেছে ।
আবার অবতীর্ণ হতে হয়েছে জীবন পরীক্ষায় ।
- “দাদার হেল্প চাও তুমি ?”
- “হ্যাঁ, বিশেষ উপকার হয় ।”
আমি ছেলেটিকে আশ্বস্ত করলাম যে কাল সকালের মধ্যে তাকে যথাসম্ভব প্রচেষ্টায় কোর্ট থেকে চালান বার করে এখান থেকে মুক্ত করব ।
সামনে লম্বা রাত , একটু জিরিয়ে
নেওয়ার পরামর্শ দিলাম । যদিও জানি এই উদ্বিগ্নতায় কোনরকম
ঘুম আসা সম্ভব নয় । অথচ কি অদ্ভুত জীবনের অনুভূতিগুলো ।
এই অন্ধকার অপরিষ্কার খাঁচার মধ্যে দুই সমবয়সী যুবক জীবনের প্রথম শ্রীঘর অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে অনুভব করছে ।
এটাই কি
অদৃষ্টের প্রভাব নাকি জীবন সাথী চয়নের ফলাফল ।
নাকি মুহূর্ত সৃষ্টির ক্ষমতাই উপহার দেয় জীবনের অনাবিল মুহূর্ত গুলকে ।
- ৩ -
রাজারহাট এই থানাটা অ্যাকশন এরিয়া তিনে । উদ্বোধন হয়েছে মাস কয়েক আগে । আমাদের সেলটা থানার দোতালায় । সেলের ছোট্ট জানালা দিয়ে রাতের আলতে নতুন তৈরি হওয়া টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল আর আলোক উদ্ভাসিত
ইউনিটেক আইটি পার্ক সন্নিবিষ্ট এলাকা দারুণ লাগছিল ।
মন যখন ভাল থাকে তখন মনে হয় সাধারণের মধ্যেও আমরা অসাধারণত্ব খুঁজে পাই ।
যদিও আজ
নিউটাউন
নিরিবিলি রবিবার বলে । তাও জানালা
থেকে ঝাঁ চকচকে লাগছে আলকজ্জল আইটি পার্ক গুলো । রাস্তা গুলো বেশ বড় বড় ,
সুন্দর করে বাঁধানো । গাড়ি চালিয়ে যে কি
মজা তা
আমার চেয়ে ভাল কে অনুভব করেছে ! ভেবে একটু হাসিই পাচ্ছে ।
আজ দিনটি ছিল ঘটনাবহুল ।
সকালে উঠেই উপহার পর্ব ।
ছন্দা একদিন বলেছিল ওর সোনার গয়নাগুলো বেশ বড়
বড় ।
সবসময় পরার একটা হালকা মঙ্গলসূত্র কিনলে হয় ।
ওর মনের মতো উপহার দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ আমি অপব্যবহার আমি করি নি । আর আমি পেয়েছি সদ্য বাজারে আসা আইফোন ছয় ।
উপহারগুলো একে অপরের বেশ পছন্দ হয়েছে । দুপুরের পারিবারিক মধ্যাহ্নভোজনর পালা সেরে বসেছিল গানের আসর । ছন্দার গানের যাদু মাতিয়ে তুলেছিল আমাদের প্রাঙ্গণ । অদ্ভুত সন্মোহনি
শক্তিতে আবেশিত হয়ে পরেছিলাম আমরা সকলে । ঠাহর করতে পারছিলাম না
কোথা থেকে দিনটা চলে যাচ্ছিলো । আর ওকে সন্ধ্যার বিমানে ফিরে যেতে হবে বলে যেন গোটা দিনটা ছোট লাগছিলো । কোথাও যেন ছিল আরেটু পাওয়ার ইচ্ছে, আরেকটু
উচ্চতার হাতছানি ।
সন্ধেবেলা
আমরা বেরলাম হাতে সময় রেখে । পরিকল্পনা মাফিক নৈশভোজ করতে গিয়েছিলাম বাইপাসের এক রেস্তোরায় । ঠিক ডিনার নয় । আর্লি ডিনার বলা যেতে পারে ।
উদ্দেশ্য নিজেদের সাথে একান্তে আরও একটু সময় কাটানো
, আর তারপরে ওকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসা । আর
সেই পথেই হল যত বিপত্তি
। ঠিক বিপত্তি নয়, অনেকটাই পাগলামো
। ছান্দার সাথে সারাদিন কাটানোর পরেও ঠিক মন
ভরছিল না
। মনে হচ্ছিল আরও একটু সঙ্গ পেলে ভাল হত, কোথায় যেন খামতি থেকে গেল দিনটায় ।
অথচ আজ
ওকে যেতেই হতো । কাল সকালে গানের রেকর্ডিং আছে ছান্দার ।
আমি চাই না কাজের ব্যাপারে
ছন্দা আপোষ করুক । কাজের উৎসর্জনই ভারসাম্য আনে ব্যক্তিগত জীবনে ।
ওর উন্নতিতে আর খ্যাতিতে আমি বেশ গর্ববোধ করি ।
রাত এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা ।
ছন্দার ফ্লাইট বম্বে পৌঁছল বলে । হয়তো খুব চিন্তায় গেছে ওর শেষ দুটো ঘণ্টা ।
দক্ষিণ কোলকাতা থেকে দাদার আস্তে আরও কিছুটা সময় লাগবে । এসব ভাবতে ভাবতে দুরের নিউ টাউন দেখছি,
এমন সময় টনক নড়ল এক
রমণীর অসময় আবির্ভাবে । চুল উষ্কখুষ্ক, বিচলিত চোখেমুখে
উদভ্রান্তির ছাপ । আর আশ্চর্যের
বিষয় এই
যে তাকে দেখে আমার সেলের ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে উঠল । রাগে ক্ষোভে শিকগুলো আঁকড়ে ধরেছে সে ।
- “ তোমার স্ত্রী নাকি ?”
- “ হ্যাঁ দাদা । আরও কতো বিপদ আনতে চলেছে জানি না
।”
আমি একটু অবাক এ হলাম । এতো রাতে একা । 498 দেওয়ার পরে কোন স্ত্রী তাঁর স্বামীকে শ্রীঘরে দর্শন করতে আসতে পারে
?
মেয়েটি দৌড়ে এলো আমাদের সেলের দিকে । এক অবিন্যস্ত
চাঞ্চল্য তার সর্বাঙ্গে ।
- “ সোনা, আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে ।
আমি আর
মায়ের কথা শুনবো না ।”
ছেলেটি মুখ ফিরিয়ে শিকগুলো ধরে মাথা নিচু করে বসে পড়লো । ক্ষোভ-লজ্জা-কষ্ট মাখানো চোখদুটি মেঝের দিকে নিবদ্ধ ।
-
“ বাবু আমায় ক্ষমা করে দাও । দ্যাখো, আমি তোমায় নিতে এসেছি । সেই দুপুর থেকে কিছু খাইনি আমি ।
তোমাকে ছাড়া ঘুম আসেনা আমার
, এটা জানোত তুমি । প্লিজ বাড়ি চলো । ”
এই নাটকে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না
। ভাবছি যে বিশ্বায়নের এই
যুগে আমাদের দেশও সব পেয়েছির দেশে পরিণত হয়েছে । কিন্তু সামাজিক
ভাবে আমাদের মানসিকতা এখনও পরিণত হয়েছে কি ? এই বিশ্বায়নের যুগে এক শ্রেণীর মেয়েদের
কাছে পৃথিবীটা মগের মুলুক, আর স্বামীরা সান্তা ক্লোজ । হয়তো সমস্যাটা আরও গভীর,
অসহিষ্ণু সমাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতার । অলীক প্রত্যাশা কিংবা পারিবারিক হস্তক্ষেপও অনেক খানি দায়ী , কিন্তু
এব্যাপারে সন্দেহ নেই যে 498 নামক যন্ত্রটি অসদুদ্দেশ্যে প্রয়োগ হচ্ছে আজকাল । মেয়েটি
অঝরে কাঁদছে । ওর কান্না
দেখে আমার একটু মায়া হল
বটে ।
-
“ কি
হয়েছে গো ,
কথা বলছেনা কেন ? আমি তোমায় ছেড়ে বাপের বাড়ি যাবো না
আর ।
তোমার দিব্যি । ”
আমি ছেলেটার পীঠে হাত রেখে বললাম
– “কথা বলো ।”
ততক্ষণে দারোগা সেলের দরজা খুলে দিয়েছে । ছেলেটি
বেরিয়েই অপ্রত্যাশিত ভাবে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল ।
আর আমি ভাবলাম – সত্যি ছন্দা, কি বিচিত্র এই বঙ্গদেশ । কি বিচিত্র এখানকার নর নারী । সবাই আলাদা, সকলের আলাদা রসায়ন । আর
রসায়নে কিছু বাহ্যিক উপাদান এসে সমীকরণটা ঘেঁটে দেয় । হয়তো এক্ষেত্রে
কোন জাঁদরেল শাশুড়ি তার মেয়েকে ইন্ধন যুগিয়েছে ।
সত্যিটা কি
তা কেউ বলতে পারবে না, কারণ সকলের আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থাকে । সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য বলে কিছু হয়না । হয় কার্যকরী
নয় বিচ্ছেদ
, কোন যুক্তিবিজ্ঞান দিয়ে বাঁধা যায় না সম্পর্কের সমীকরণ । তবে দিনকাল ক্রমশ বদলাচ্ছে । আধুনিক বঙ্গীয়
যুবক যুবতীরা যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্য , পরিণত । ঠিক দুই দশক আগে সমাজ চলত অন্য ভাবে । শোনা যেত বিয়েতে বাড়ির অসন্মতির কথা , কিংবা ত্রিকোণ প্রেম,
অথবা জবরদস্তি বিয়ে দেওয়া, বা প্রেম ছিনিয়ে আনা । কিন্তু প্রায় সব গল্পই শেষ হত বিয়ের পিঁড়িতে । এখন সমাজ একটু বদলেছে । বর্তমানের বিবাহিত স্বামী স্ত্রী দের বন্ধুও তারা, শত্রুও
তারা ।
সময়ের সাথে বায্যিক সম্পর্কের অবকাশ বেড়েছে । সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অফিসিয়াল পরিচিতি । অবকাশ সর্বত্র । কিন্তু নিজেদের বিশ্বাস সমীকরণ রসায়ন ঠিক থাকলে হাজার অবকাশও সেই দুর্ভেদ্য সম্পর্কের প্রাচীর ভেদ করতে পারে না । আর যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই সমস্যা থাকে, তখন বিকল্প
নানা দিক দিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ।
তাই আজকের শিক্ষিত পার্টনারকে পাহারা দিতে হয় না
। শুধু মন খুলে হৃদয় দিয়ে সম্পর্কটা রাখতে হয়, নিজের মতো করে । ঠিক এই কারণে আমি ছন্দাকে নিয়ে নিরাপত্তা হীনতা অনুভব করি নি । যতই দূরে থাকুক, যত লোকের সাথেই মিশুক,
আমার প্রতি ওর ভালোবাসা অটুট থাকবে ।
- ৪ -
আমার কাছে জীবন হল মুহূর্তের সমষ্টি । আর প্রতিটি
মুহূর্ত আলাদা আলাদা ক্যানভাস ।
তাই প্রতিটি ক্যানভাসকে বর্ণবহুল করার দায়িত্বও আমাদের ।
তাতে রঙের ছটা ফেলে , নিজের মনের মাধুরী ঢেলে আমরাই সাজাতে পারি । রঙিন করে তুলতে পারি ক্যানভাসগুলো , যেগুলি রয়ে যাবে স্মৃতির মণিকোঠায়
, চিত্ত ভরিয়ে দেবে অনাবিল আনন্দে । আমার বার বার মনে পরছে আজকের কিছু মুহূর্ত ।
লাল ট্র্যাফিক সিগন্যাল ভেঙ্গেছি নিজের খামখেয়ালীতে কিংবা অনেকটা নিজের ইচ্ছেতেই ।
ছন্দাকে খুশি করতে, ফুরিয়ে যাওয়া দিনটিকে চরম উচ্চতা দিতে বা
হয়তো আমার বাঁধভাঙ্গা ভালোবাসা উজাড় করে দিতে ।
জানিনা কেন এরকম করেছি, এর পেছনে গুঢ় রহস্য কি, তবে কি সত্যই আমি নিরাপত্তা হীনতায় ভুগি ! নাকি ছন্দার
ভালোলাগাগুলো আমার চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে ! না , নিরাপত্তা হীনতা নয় । আবার নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়াও নয় ।
কোন সম্পর্ক কেই টেকেন ফর
গ্র্যান্টেড নেওয়া ঠিক নয় ।
ছন্দা আর
পাঁচটা মেয়ের মত নয়, যারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা করবে আর
নারীবাদী বুলি আওড়াবে । বিলেনিয়ার প্রয়োজককে জীবনসঙ্গী
করে, তার থেকে রোমান্স না পেলে উগরে দেবে বিদ্বেষের ফল্গুধারা ।
আজকের মেয়েরা প্রেম করবে সহপাঠীর সাথে, আর বিয়ে করবে এন
আর আই
কে, নিজেদের
চেয়ে অপেক্ষাকৃত উচ্চ প্রতিষ্ঠিত , উচ্চ উপার্জন করা ছেলেকে জীবনসঙ্গী করে সাম্যের গান গাইবে।
ছন্দা সে
পথে হাঁটেনি । আমি ওর সহপাঠী প্রেমিক । আমাদের পারস্পারিক
শ্রদ্ধা আর
একে অপরকে খুশি করার অকৃত্রিম ইচ্ছের জন্য, প্রতিষ্ঠা
পাওয়ার পরে ভালোবাসাতে চিড় ধরেনি । আর
এই উপচে যাওয়া ভালোবাসা উপহার দিতে গিয়েই যত
বিপত্তি ।
যদিও বিপত্তিটা মটেই খারাপ লাগছে না, বরঞ্চ অনুভব করছি তাড়িয়ে তাড়িয়ে । ঠিক যেমন অনুভব করেছিলাম বাইপাসের ওপর লাল ট্র্যাফিক সিগন্যাল ভেঙ্গে । একটু দেরি হয়ে যাচ্ছিল এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে ।
তাই পঞ্চম গিয়ারে গাড়িটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি নি ।
আর সেই নিয়ম ভাঙ্গাটা ছন্দাকে দারুণ উত্তেজিত করে তুলেছিল । ট্রাফিক পুলিশের পেছন থেকে দাণ্ডা তুলে চিৎকার আমাদের গাড়ির মধ্যে তুলেছিল আলোড়নের জোয়ার । চনমনে হয়ে উঠেছিলো ছন্দা । আর সেই ভালোলাগার ছোঁয়া আমাকে করে তুলেছিল আরও বেপরোয়া ।
আবার ভাঙ্গলাম সিগন্যাল । হ্যাঁ , একবার নয়, বেশ কয়েকবার ।
রবিবার বিকালের অপেক্ষাকৃত শান্ত বাইপাসে একশোর গতিবেগে গাড়িটাকে ছোটালাম । সাথে বিট দেওয়া বলিয়ুডী গানগুলো উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের ।
যেন শুটিং করছি জার্মানির অটোবানে । যেখানে নেই কোন গতির বিধিনিষেধ । সেই গতিবেগের নিষেধ হয়ত ভারতবর্ষেও নেই, কিন্তু
লাল সিগন্যাল আছে , ট্র্যাফিক পুলিশের সাথে আছে সার্জেন্টের দল । আর
ভাগ্যিস আছে,
তা না
হলে খেলাটাই জমত না । আমাদের
স্বপ্নের ড্রাইভটা রাতারাতি হয়ে গেল ভিডিও গেমস ।
এই তাসের দেশে যখন নিয়ম ভাঙ্গার খেলায় মেতেছি তখন প্রাণ খুলে ভাঙ্গি । আর
সেই অনাস্বাদিত আনন্দ ততক্ষণে প্লাবিত করেছে ছন্দাকে ।
ওর চোখে একদিকে উদ্বিগ্নতা অন্যদিকে উত্তেজনার আনন্দ ।
কিন্তু মুখে সাবধানী বুলি – “কি করছ অভি,
থামো” ! আর আমি গতি তুলেছি আরও জোড়ে । পেছনে কলকাতা
পুলিশের বাইক বাহী সার্জেন্টের দল, আর কিছুক্ষণ পরে একটা ভ্যানও দেখলাম সাইরেন বাজিয়ে ধাওয়া করছে আমাদের । আমার ভীষণ ভাল লাগছিলো নিয়ম ভাঙ্গতে, আর সেই অকল্পনীয় মুহূর্তটাকে ছন্দাকে উপহার দিতে । মনে হচ্ছিল এতক্ষণে সার্থক হল দিনটা । এরপর যা
হওয়ার হবে,
দেখা যাবে । ছোটাই আরও একটু । আমার মতো ভীতু সাধারণ নিয়ম মানা তথ্য প্রযুক্তির ছেলে যে
সামান্য ক্লায়েন্ট এস্কালেসনে
আতকে ওঠে
, তার মধ্যেও কত ছায়াবৃত ।
আমার মধ্যে থেকে যে এমন একটা চরিত্র বেড়িয়ে আসবে , সেটা ছন্দা কেন আমার নিজের কাছেও চরম অবিশ্বাস্য । কিন্তু সাথে সাথে সাবধানী মাথা বারংবার মনকে বোঝাচ্ছিল যে এই
দু:সাহসিক
বিপজ্জনক কর্মপ্রচেষ্টার চক্করে
ছন্দার ফ্লাইট না মিস হয়ে যায় । তাই হঠাৎ বাইপাস থেকে ডানদিক নিয়ে ঢুকে পরলাম সল্টলেকে , কোলকাতা
পুলিশের এক্তিয়ার থেকে বেড়িয়ে রাজ্য পুলিশের চত্বরে ।
জানতাম সোজা গেলে, উল্টোডাঙা ফ্লাইওভার অতিক্রম করলেই পড়তাম কোলকাতা পুলিশের বেড়াজালে । সল্টলেক পেরিয়ে রাজারহাট হয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে বেশী সময় লাগলো না
। সারাক্ষণ বড্ড উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ছন্দাকে । এই
চলচ্চিত্রিক অভিজ্ঞতার ফলস্বরুপ মাত্রাতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ আমাদের নিয়ে গেয়েছিল এক অন্য জগতে । ছন্দা গান ধরেছিল – “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো ... ।”
পথ শেষ হয়েছিল
এবং পরবর্তী ব্যাপারটা আপাত সুখকর হয় নি । ছন্দা যথাসময়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছেছিলো ।
এয়ারপোর্ট ছেড়ে রাজারহাটের রাস্তা ধরতেই রাজ্য পুলিশের সহায়তায় কোলকাতা পুলিশ আমায় ধরেছিল এয়ারপোর্টের টোল পোস্টে আমার গাড়ির নাম্বার ট্র্যাক করে । আর তার ফলস্বরূপ এই শ্রীঘরের অমোঘ অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি হল
আজ ।
দাদা এসেছে ।
পেপার ওয়ার্ক সারছে । এমন সময় এলো ছন্দার ফোন ।
- “ তুমি ঠিক আছো তো ?
”
- “ একদম বিন্দাস । ”
- “ আমি তোমায় ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি ।
” আবেগমথিত কম্পমান গলায় বলল ছন্দা ।
জীবনখাতার এই ড্রাইভের ক্যানভাসটায় আমাদের প্রেমের রামধনুর সবকটা রঙ
বর্ণবহুল হয়ে থাকবে চিরকাল।
-------------০--------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন