১৯৭১ সালের ৭ই
নভেম্বর : মুক্তিযোদ্ধা
খন্দকার আবুল কাশেম আর আমি টাঙ্গাইল সেক্টরে অপারেশন চালাচ্ছি । টাঙ্গাইল সদরের কাছে মীরের বেতকায় আমাদের ঘাঁটি । পাকসেনারা বুঝতে পেরেছে পরাজয় আসন্ন । ওরা নির্বিচারে
গনহত্যা চালাচ্ছে । আমাদের টাঙ্গাইল
সেক্টরের এরিয়া কমান্ডার কাদের সিদ্দিকীর অধীনে গ্রুপ লিডার কাশেমের নেতৃত্বে আমি অপারেশন চালাই ।
আমাদের উপড় নির্দেশ এলো ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ভাতকুড়ার কাছে বড়পুল উড়িয়ে দিতে হবে । আরেক দলের কাছে নির্দেশ গেল বাংড়া গ্রামের কাছে পুংলির
পুল উড়িয়ে দিতে হবে ।
যার ফলে ঢাকা থেকে সরাসরি বা ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইল সদরে কোন সামরিক সাহায্য না
ঢুকতে পারে । বাংড়া গ্রামের
কাছে পুংলির পুল ওড়ানোর দায়িত্ব পড়ে মেজর বাতেনের কাঁধে । তারা ঐ কাজ ভালভাবেই
সমাধা করেণ । আমরা রাত বারোটার সময় অপারেশন স্থলের দিকে রওনা হতেই একদল পাকসেনার মুখে পরে যাই । ক্রশ ফায়ারিঙ্গে আমাদের দলের দশজনের ভিতরে আটজনই মারা যায় । প্রায় তিরিশ জন
পাকসেনাও খতম হয় । কিন্তু অচিরেই গাড়ী ভর্তি করে পাকসেনা চলে আসে । আমরা দুজন পালিয়ে ভাতকুড়া গ্রামে আশ্রয় নেই ।
পাকসেনারা ক্ষ্যাপা কুত্তার মত আমাদের খুঁজতে থাকে ।আমরা ভাতকুড়া গ্রামের হরিদাস বসাকের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলাম ।
বাড়ীটি ছিল পরিত্যক্ত । কারণ হরিদাস বসাক পালিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন । পরদিন ভোরে আমরা হাতিলা গ্রামে হজরতের বাড়ীতে আশ্রয় নিই ।
রাজাকার ও
আলবদর বাহিনীর সাহায্যে পরদিন পাকসেনা এসে হরিদাস বসাকের বাড়ী পুড়িয়ে দেয় । তারপর ভাতকুড়া
গ্রামের দশ
থেকে আটত্রিশ বছর বয়সী পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে লাল লোহার পুলের নীচে হাত পা
বেঁধে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে । আর
দশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী নারীদের প্রথমে খানসেনা
, পরে রাজাকার আলবদর-রা ধর্ষন করে ।
আমরা পরদিন রাতে বড়পুলের নীচে ডিনামইট ফিট করে ওটি উড়িয়ে দিই । তারপর টাঙ্গাইল
শহরে প্যাড়াডাইস পাড়ায় গোপেশ্বর বসাকের বাড়ীতে আস্তানা গাড়ি । গোপেশ্বর বসাকও স্বজন বান্ধব সহ
ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু
খান সেনাদের খোঁচর ( রাজাকার/আলবদর ) তক্কে তক্কে ছিল । রাতে প্যাড়াডাইস পাড়া রেইড করলো । ওরা তখন মরিয়া ।
ঢাকা থেকে সাহায্য আসা বন্ধ । রসদও ফুরিয়ে
আসছে ।
নির্বিচারে ওরা গনহত্যা
চালাচ্ছে ।
টাঙ্গাইল শহরের প্রায় অর্দ্ধেক লোককে ওরা মেরে ফেলেছে । আমাদের কাছে পটাসিয়াম সায়ানাইড ছিল । নির্দেশ ছিল কোনভাবেই ধরা পড়লে চলবে না
।
গ্রুপ লিডার কাশেম বললেন মরতে হবেই ।
কিন্তু এমনি মরবো না ।
শোন আমি পটাশিয়াম সায়ানাইড খাচ্ছি । মরার পরে তুমি আমাকে কেটে রান্না করবে । তারপর সব সায়ানাইড ওতে ঢেলে দেবে ।
অনেকদিন পরে মাংস খাওয়ার আনন্দে ওরা তেঁতো স্বাদ টেরই পাবে না
। রান্না শেষ করে তুমি পায়খানার পিছনে লুকিয়ে পড়বে । খাওয়ার আগে ওরা অন্যকিছু ভাববে না বা
কারো খোঁজ করবেনা । সব
খানসেনা সাবাড় হওয়ার পর তুমি পাশের লৌহজঙ্গ নদী সাঁতরে ওপাড়ে যাবে ।সেখানে মেজর বাতেন আছেন , তাকে সব খুলে বলবে । আমি প্রতিবাদ করতেই উনি বললেন , এটা গ্রুপ লিডার হিসাবে আমার আদেশ ।
একজন সৈনিক হিসাবে তোমাকে এটা মানতেই হবে ।
উনার কথামতই কাজ হলো । মাংস খাওয়ার আনন্দে ওরা তেঁতো স্বাদ টেরও পেলোনা । সবক’টা (পঁচিশ জন ) পটাপট মরলো ।
আমি লৌহজঙ্গ নদী সাঁতরে ওপারে গেলাম । তারপর এক কিলোমিটার হাঁটার পরে বাসাখানপুরে মেজর বাতেনের লোকেরা আমাকে ধরে মেজরের কাছে নিয়ে গেল ।
মেজর সব
শুনে উল্লসিত হয়ে এরিয়া কমান্ডার কাদের সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করলেন ।
স্থির হ’ল তিনদিন পরেই টাঙ্গাইল দখল করতে হবে ।
তিনদিন পরে শুরু হ’ল অপারেশন জয়
বিজয় ।
আমরা বিজয় পেলাম । কিন্তু শেষ মুহুর্তে একটি গুলি এসে লাগলো আমার পাঁজরে । বাঁচার কোন আশাই ছিল না । তবু বেঁচে গেলাম বিজয় দেখবো বলে । তারপর ষোলই ডিসেম্বর রচিত হ’ল ইতিহাস
। জন্ম হ’ল স্বাধীন
বাংলাদেশের ।
এতকথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধ হাঁপিয়ে গেলেন । কলকাতার জি.ডি.হসপিটালে
আমার পাশের বেডেই ছিলেন উনি । আমার সাথে পরিচয়ের পর যখন ককক আমাদের পিতৃপুরুষের বাড়ী ছিল টাঙ্গাইলের ভাতকুড়া গ্রামে তখন তিনি আমাকে এই কাহনী শোনান । আমি একটু আধটু লিখে থাকি জেনে আমাকে অনুরোধ করেণ আমি যেন তার নাম না
জানাই ।
তাই নাম লিখলাম
না ।
আমি তাকে বলেছিলাম এতকিছু করে কি সুখ পেলেন ? উনি বলেছিলেন শোন হে ছোকরা , “১৯৭১ – এ আমার বয়স ছিল ২৭ বছর । অর্থাৎ আমার বর্তমান বয়স ৭০
বছর ।
আমি কোনদিন
নিজের সুখ চাইনি আমাদের মত
লাখো শহীদের আত্মত্যাগের ফলে স্বাধীনতা এসেছে ।স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নতি
দেখে সবাই ঈর্ষাণ্বিত ।রাস্তাঘাট এখন বিশ্বমানের । কলকাতার মত এবরো খেবরো নয় ।টাঙ্গাইল
এখন উন্নত জেলা । ঢাকা শহর দেখলে তাক লেগে যাবে ।
তোমাদের পিতৃ-মাতৃকুলের বাসভূমি ভাতকুড়া গ্রাম আর
অজ পাড়াগাঁ নেই । সেখানে রাস্তা
হয়েছে , ঘরে ঘরে বিদ্যুত এসেছে ।অটো রিক্সা চলে ।একবার গিয়ে দেখে এসো উন্নতি কাকে বলে ।
জয় চেয়েছিলাম , বিজয়ী আমি আজ, ক্ষুদ্রসুখে
ভরে না’ক মুক্তিযোদ্ধার ক্ষুধা ,দীপ্ত জ্বালা অগ্নি ঢালা সুধা”
। বলেই তিনি চোখ বুজলেন । পরদিন ভোরে উনি মারা যান । মৃত্যুর পরেও তার মুখে লেগেছিল বিজয়ের প্রশান্তি ।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন